ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র ১ম অধ্যায় প্রশ্নোত্তর

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র ১ম অধ্যায় প্রশ্নোত্তর:  ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এক চমকপ্রদ ঘটনা। সপ্তম শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ইসলামের রাষ্ট্রীয় বিস্তৃতি দুনিয়াব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। অষ্টম শতকের শুরু থেকেই আরকগণ স্পেন, পর্তুগাল ও আফ্রিকার অংশবিশেষ, সিরিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান, ইরাক প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে বিরাট মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

তাদের এ সকল বিজয়ের ধারাবাহিকতা অধিকতর নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে নানা সময়ে এতদ্বঞ্চলে অভিযান প্রেরিত হয়। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) ও ওসমান (রা.)-এর সময় মোট দুইবার ব্যর্থ অভিযানের পর ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু মুসলমানদের অধিকারে আসে। কিন্তু উমাইয়া খেলাফতে সৃষ্ট সংকটের কারণে পরবর্তীতে সিন্ধুতে মুসলিম শাসন নিরবচ্ছিন্নভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রায় তিন শতাব্দী পর ভারতবর্ষে তুর্কিদের নেতৃত্বে মুসলিম অভিযানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। আফগানিস্তানের রাজধানী গজনি থেকেই তারা ভারতবর্ষে তাদের দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। যদিও প্রথমে কেবল পাঞ্জাব দখলের মাধ্যমে তারা এদেশে রাজ্যজয়ের সূত্রপাত করে, কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের প্রচেষ্টার ফলেই সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। গজনি বংশের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে ওঠা ঘুরীদের নেতৃত্বে নবতর যুগের সূত্রপাত হয়। তাদের তেজোদীপ্ত নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে মুসলিম শাসন-সংস্কৃতি বিস্তৃত ও বিকশিত হয়। তাদের উত্তরসূরিদের দাস সালতানাতের প্রতিষ্ঠা ও শাসনে-লালনে নতুন ধারার জন্ম দেয় এবং ভারতে সুদীর্ঘ পাঁচ শতাধিক কাল (১২০৬-১৭৫৭ খ্রি.) বংশপরম্পরায় মুসলিম শাসন অব্যাহত থাকে।


ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্র ১ম অধ্যায় প্রশ্নোত্তর

১. ভারতবর্ষকে ‘নৃতত্ত্বের জাদুঘর’ বলা হয় কেন?

উত্তর: ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্ম-বর্ণের মানুষ বসবাস করায় এটিকে সাধারণত ‘নৃতত্ত্বের জাদুঘর’ বলা হয়। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বহু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ভারতে প্রবেশ করেছে। প্রাচীনকালে আর্য, দ্রাবিড়, পারসিক, গ্রিক, শক, কুষাণ, হুন এবং মধ্যযুগে আরব, তুর্কি, আফগান, মুঘল প্রভৃতি জাতি এদেশে এসেছে। এছাড়া আধুনিক যুগে পর্তুগিজ, ইংরেজ, ফরাসি প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর আগমনের ফলে ভারতবর্ষ বহু জাতিগোষ্ঠীর মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতবর্ষকে নৃতত্ত্বের জাদুঘর বলে অভিহিত করেছেন।

২. মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক অবস্থার বিবরণ দাও?

উত্তর: নানা রকম ঘৃণ্যপ্রথা ও কুসংস্কার বিদ্যমান থাকায় মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না।

মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে হিন্দুধর্মের প্রবল প্রাধান্য ছিল। হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল সংকীর্ণ জাতিভেদ প্রথা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এ চার শ্রেণিতে হিন্দু সমাজ বিভক্ত ছিল। এরূপ বিভেদ জাতীয় চেতনা না ও ও শক্তি গঠনের প্রধান অন্তরায় ছিল। এ কারণে সমাজে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নানাভাবে অবহেলিত হতো। তাছাড়া সে সময় বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, নরবলি, গঙ্গায় শিশু-সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কু-প্রথা প্রচলিত ছিল। এমনকি দাস-দাসীও ক্রয়- বিক্রয় চলত। সব মিলিয়ে তাই তৎকালীন সামাজিক অবস্থ্য বিশৃঙ্খল ও শোচনীয় ছিল।

৩. মুসলমানদের আগমনের পূর্বে ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থা কেমন ছিল?

উত্তর: মুসলমানদের আগমনের পূর্বে ভারতীয় সমাজে সার্বিকভাবে নারীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল।

প্রাক-মুসলিম ভারতীয় সমাজে সতীদাহ প্রথা ও বল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। তাছাড়া বিধবা বিবাহ প্রথার বিলোপ ঘটেছিল। তাই নারীরা সমাজে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। এর ফলে নারীর সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। তারা সব ধরনের অধিকার বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এ চিত্র নিম্ন শ্রেণির নারীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যেত। অভিজাত পরিবারের নারীরা শিক্ষা গ্রহণ ছাড়াও সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পেত।

৪. আরবদের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?

উত্তর: আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না।

প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস থেকে জানা যায় মৌর্য মহারাজা অশোক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্ব) ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে সাম্রাজ্যে অনেক ক্ষুদ্র রাজ্য, যেমন- আফগানিস্তান, কাশ্মীর, কনৌজ, দিল্লি ও আজমির, সিন্ধু, মালব, গুজরাট, বুন্দেলখন্ড, নেপাল, আসাম, বাংলা গড়ে ওঠে এবং একে অন্যের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সর্বদা দ্বন্দ্ব ও কলহে লিপ্ত থাকত।

৫. তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

দিল্লীশ্বর পৃথ্বিরাজ ও মুহাম্মদ ঘুরীর সঙ্গে ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল একটি চূড়ান্ত মীমাংসাত্মক যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ফলে স্থায়ীভাবে ভারতবর্ষে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধে মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি ও তার বাহিনী সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে যুদ্ধ করে পৃথ্বিরাজ (দিল্লি ও আজমিরের শাসনকর্তা) ও সম্মিলিত রাজপুত বাহিনীকে পরাজিত করে। ফলে ভারতীয় রাজ্যগুলোর ওপর মুহাম্মদ ঘুরির চূড়ান্ত সফলতা সুনিশ্চিত হয় এবং ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

৬. প্রাচ্যের বিস্ময় বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: গজনিতে নির্মিত স্বর্গীয় বধূ নামক মসজিদকে প্রাচ্যের বিস্ময় বলা হয়।

সুলতান মাহমুদ গজনিকে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা, অসংখ্য মাদ্রাসা ও মসজিদ দ্বারা সুসজ্জিত করেছিলেন এবং এটি এশিয়ার অন্যতম সুন্দর শহরে পরিণত হয়েছিল। তিনি ‘স্বর্গীয় বধূ’ নামে গজনিতে একটি বৃহৎ ও দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ এটিকেই ‘প্রাচ্যের বিস্ময়’ বলে বর্ণনা করেছেন।

৭. সিন্ধু বিজয়ের অর্থনৈতিক ফলাফল কীরূপ ছিল?

উত্তর: আরবদের সিন্ধু বিজয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল বয়ে এনেছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিন্ধু ও মুলতান ছিল অপেক্ষাকৃত অনুর্বর। এখান থেকে সরাসরি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব ছিল না সত্য তবে এ বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তাদের লেনদেন আরও ব্যাপকতর হয়। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় উপকূলে আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্য সুদূরপ্রসারী হয়, যা তাদের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখে।

৮. ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ভারতবর্ষ এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত। ভৌগোলিক দিক থেকে ভারতবর্ষ একটি বিচিত্র অঞ্চল। এর উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিকে হিমালয় পর্বত, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, পশ্চিমে আরব সাগর অবস্থিত। বর্তমানে ভারতবর্ষ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এই তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত। ভারতবর্ষের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কিথ্য পর্বত ভারতকে দুটি অসমান ভাগে বিভক্ত করেছে। বিখ্য পর্বতের উত্তর অংশ ‘আর্যাবর্ত’ বা উত্তর ভারত এবং দক্ষিণাংশ ‘দাক্ষিণাত্য’ নামে পরিচিত।

৯. সতীদাহ প্রথা কী? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: প্রাচীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত স্বামীর মৃতদেহের সাথে বিধবা স্ত্রীকে একই চিতায় পুড়িয়ে মারার প্রথাই সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত।

মৃত স্বামীর প্রতি বিধবা স্ত্রীর চূড়ান্ত আনুগত্য প্রদর্শনের একটি নিষ্ঠুর আচার হিসেবে প্রাচীন সমাজে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সতীদাহ প্রথা মেনে চলত। তখন স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দিত। কিন্তু কালক্রমে এটি হিন্দু সমাজে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায় রূপ নেয়। এক সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজপতিরা বিধবাদের মৃত স্বামীর সাথে সহমরণ বরণ করে নিতে বাধ্য করে। তারা জোর করে অনেক বিধবাদের মৃত স্বামীর সাথে পুড়িয়ে মারতে শুরু করে। হিন্দু সমাজের এ জঘন্য ও নিষ্ঠুর রীতিই সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত। যা বর্তমানেও ভারতের কিছু অঞ্চলে দেখা যায়।

১০. তৃতীয় শাহজাদা আলাউদ্দিন হুসাইন কেন ‘জাহানসুজ’ উপাধিপ্রাপ্ত হন?

উত্তর: প্রতিশোধস্পৃহা থেকে গজনি রাজ্যটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করায় তৃতীয় শাহজাদা আলাউদ্দিন হুসাইন ‘জাহানসুজ’ উপাধি লাভ করেন।

গজনির সুলতান বাহরাম শাহ ঘুর রাজ্য আক্রমণ করে কুতুবউদ্দিন ও সাইফউদ্দিন নামক দুজন শাহজাদাকে হত্যা করেন। এ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তৃতীয় শাহজাদা আলাউদ্দিন ১১৫১ সালে গজনি অধিকার করে ৭ দিন ৭ রাত ধরে গজনি ধ্বংস করে। এজন্য তিনি ‘জাহানসুজ’ বা ‘পৃথিবী দাহক’ হিসেবে খ্যাত হন।

১১. সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বিপুল ধন-ঐশ্বর্য সংগ্রহ করা।

সুলতান মাহমুদ ১০০০-১০২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ১৭ বার ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। গজনির শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং এটিকে সমৃদ্ধিশালী ও আকর্ষণীয় নগরীতে পরিণত করা সুলতান মাহমুদের উদ্দেশ্য ছিল। এছাড়া সমরনায়ক হিসেবে একটি বিশাল সেনাবাহিনী পোষণের জন্য তার অনেক অর্থের দরকার ছিল। ফলে ধন- ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশকে তিনি তার প্রয়োজনীয় অর্থভান্ডার মনে করে সেখানে ১৭ বার অভিযান পরিচালনা করেন। আর ভারত থেকে সংগৃহীত অর্থ তিনি নিজ রাজ্য গজনির উন্নতিতে ব্যয় করেন।


আরও দেখুন: ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ১ম পত্র ৭ম অধ্যায় প্রশ্নোত্তর

আশাকরি আমাদের আজকের আর্টিকেল টি ভালো লেগেছে। কোথাও বুঝতে সমস্যা হলে বা আরও কিছু জানার থাকলে কমেন্টে আমাদের জানাতে পারেন। ভালো থাকবেন সবাই, ধন্যবাদ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *